কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য আবেদন করবেন কিভাবে

কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য আবেদন করবেন কিভাবে

বর্তমান সময়ে বিদেশে কাজ করার স্বপ্ন অনেক তরুণ-তরুণীর মনেই লালিত হয়। বিশেষ করে উন্নত জীবনযাপন, উচ্চ বেতন, এবং নিরাপদ পরিবেশের কারণে কানাডা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য। কানাডায় কাজ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা বা Canadian Work Permit নিতে হবে। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত জানব  কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা আসলে কী, কে আবেদন করতে পারেন, কী কী যোগ্যতা দরকার, আবেদন প্রক্রিয়া কীভাবে হয়, এবং সফলভাবে ভিসা পাওয়ার জন্য কিছু কার্যকর টিপস।


 কানাডা ওয়ার্ক পারমিট কী?

কানাডা ওয়ার্ক পারমিট হলো এমন একটি অফিশিয়াল ডকুমেন্ট যা বিদেশি নাগরিকদের কানাডায় বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি দেয়। এটি Immigration, Refugees and Citizenship Canada (IRCC) কর্তৃপক্ষ দ্বারা ইস্যু করা হয়। এই পারমিট সাধারণত একটি নির্দিষ্ট চাকরি, নির্দিষ্ট কোম্পানি এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে,ওপেন ওয়ার্ক পারমিট (Open Work Permit) পাওয়া যায়, যা দিয়ে আবেদনকারী বিভিন্ন নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করতে পারেন।


 কানাডা ওয়ার্ক পারমিটের ধরন

ওয়ার্ক পারমিট মূলত দুই ধরনের হতে পারে:

 1. Employer-Specific Work Permit

এটি সবচেয়ে সাধারণ ওয়ার্ক পারমিট, যেখানে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করতে হয়। এই ভিসায় আপনি শুধুমাত্র সেই কোম্পানিতেই কাজ করতে পারবেন, যাদের কাছ থেকে Job Offer Letter এবং LMIA (Labour Market Impact Assessment) অনুমোদন পাওয়া যায়।


 2. Open Work Permit

এই পারমিটে আপনি যেকোনো কানাডিয়ান কোম্পানিতে কাজ করতে পারেন, তবে কিছু নির্দিষ্ট শর্তে।এটি সাধারণত দেওয়া হয়: আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্পাউসদের,কানাডায় স্থায়ী বসবাসের আবেদনকারীদের, কিছু বিশেষ প্রোগ্রামের আওতায় (যেমন Post-Graduation Work Permit)


 কানাডা ওয়ার্ক পারমিটের জন্য কারা আবেদন করতে পারেন

যে কেউ কানাডায় বৈধভাবে কাজ করতে চান এবং নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করেন, তিনি আবেদন করতে পারেন: বৈধ Job Offer Letter থাকতে হবে (যদি Employer-Specific Work Permit চান)।  নিয়োগকর্তার LMIA অনুমোদন থাকতে হবে (যদি প্রয়োজন হয়)। আবেদনকারীর বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হতে হবে। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।  স্বাস্থ্যগতভাবে উপযুক্ত হতে হবে এবং মেডিকেল টেস্ট পাস করতে হবে।  অপরাধমূলক রেকর্ড না থাকা (Police Clearance Certificate প্রয়োজন)। ভিসার মেয়াদ শেষে কানাডা ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে।


কানাডা ওয়ার্ক পারমিটের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট

ওয়ার্ক পারমিট আবেদন করার আগে নিচের ডকুমেন্টগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে:বৈধ পাসপোর্ট (কমপক্ষে ৬ মাস মেয়াদসহ) Job Offer Letter (নিয়োগকর্তার কাছ থেকে) LMIA (Labour Market Impact Assessment) বা LMIA-exempt প্রমাণ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র কর্ম অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র  সাম্প্রতিক পাসপোর্ট সাইজ ছবি মেডিকেল সার্টিফিকেট (IRCC অনুমোদিত ডাক্তার দ্বারা প্রদত্ত) পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ব্যাংক স্টেটমেন্ট (আর্থিক সামর্থ্য প্রমাণের জন্য) ভিসা আবেদন ফি প্রদানের প্রমাণ


আবেদন প্রক্রিয়া: ধাপে ধাপে নির্দেশনা

চলুন এখন দেখি ধাপে ধাপে কীভাবে আপনি কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন

 

ধাপ ১: চাকরির অফার সংগ্রহ করা

প্রথমেই আপনাকে কানাডার কোনো কোম্পানির কাছ থেকে একটি Job Offer Letter নিতে হবে। চাকরি খোঁজার জন্য জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটগুলো হলো:

 [Job Bank Canada](https://www.jobbank.gc.ca/)

 [Indeed Canada](https://www.indeed.ca/)

 [LinkedIn](https://www.linkedin.com/)

 [Glassdoor](https://www.glassdoor.ca/)

 [Monster Canada](https://www.monster.ca/)

চাকরি পাওয়ার পর আপনার নিয়োগকর্তাকে LMIA অনুমোদন নিতে হবে, যা প্রমাণ করে যে সেই কাজের জন্য কোনো কানাডিয়ান নাগরিক পাওয়া যায়নি, তাই বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।


 ধাপ ২: অনলাইনে অ্যাকাউন্ট তৈরি করা

কানাডা সরকারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যান: 

🔗 [https://www.canada.ca/en/immigration-refugees-citizenship.html](https://www.canada.ca/en/immigration-refugees-citizenship.html)

এখানে Apply for a Work Permit অপশনে ক্লিক করে একটি প্রোফাইল তৈরি করুন।


 ধাপ ৩: আবেদন ফর্ম পূরণ করা

আপনাকে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করতে হবে, যেখানে নিচের তথ্যগুলো দিতে হয়: ব্যক্তিগত তথ্য  শিক্ষাগত যোগ্যতা কর্ম অভিজ্ঞতা চাকরির অফার বিস্তারিত ভ্রমণের ইতিহাস পারিবারিক তথ্য সব তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ ভুল তথ্য দিলে আবেদন বাতিল হতে পারে।


 ধাপ ৪: প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড ও ফি প্রদান

ফর্ম পূরণের পর আপনি আপনার ডকুমেন্টগুলো (PDF বা স্ক্যান কপি) আপলোড করবেন এবং অনলাইনে ভিসা ফি প্রদান করবেন। বর্তমান ফি: Work Permit fee: CAD 155, Biometrics fee: CAD 85


 ধাপ ৫: বায়োমেট্রিকস প্রদান

আবেদন জমা দেওয়ার পর আপনাকে একটি Biometrics Instruction Letter দেওয়া হবে। এরপর আপনাকে নিকটস্থ Visa Application Centre (VAC) এ গিয়ে ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে বায়োমেট্রিকস দেওয়া যায় VFS Global, ঢাকা অফিসে।


 ধাপ ৬: মেডিকেল টেস্ট সম্পন্ন করা

IRCC অনুমোদিত কোনো প্যানেল ডাক্তার দ্বারা মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে। মেডিকেল রিপোর্টে যদি দেখা যায় আপনি সুস্থ এবং কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত নন, তবে আপনার ফাইল প্রসেসিং এগিয়ে যাবে।


 ধাপ ৭: আবেদন যাচাই ও সিদ্ধান্ত

সব ধাপ শেষ হলে IRCC আপনার আবেদন যাচাই করবে।

যদি সব ঠিক থাকে, তাহলে আপনি একটি Port of Entry (POE) Letter of Introduction পাবেন। এই লেটারটি নিয়েই আপনি কানাডায় প্রবেশের সময় ইমিগ্রেশন অফিসারকে দেখাবেন, এবং সেখানেই আপনাকে Work Permit ইস্যু করা হবে।


 প্রসেসিং টাইম

ওয়ার্ক পারমিট ভিসা প্রসেসিং সময় ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত: বাংলাদেশ থেকে আবেদন করলে: ৮ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। তবে এটি নির্ভর করে ফাইল সম্পূর্ণতা, মেডিকেল ক্লিয়ারেন্স এবং অফিসের কাজের চাপের উপর।


 কানাডায় জনপ্রিয় কিছু চাকরির ক্ষেত্র

কানাডা দক্ষ কর্মী ও অভিজ্ঞ শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে কাজের সুযোগ দিচ্ছে। কিছু জনপ্রিয় সেক্টর হলো: স্বাস্থ্যসেবা (নার্স, কেয়ারগিভার, ফার্মাসিস্ট তথ্যপ্রযুক্তি (সফটওয়্যার ডেভেলপার, আইটি সাপোর্ট) কনস্ট্রাকশন (ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার, কার্পেন্টার) কৃষি ও ফুড প্রসেসিং ট্রাক ড্রাইভার ও লজিস্টিকস  হোটেল ও রেস্টুরেন্ট (কুক, ওয়েটার, হাউজকিপার)

সাধারণ ভুল যা এড়িয়ে চলা উচিত  ভুয়া বা অবৈধ জব অফারে আবেদন করা। অসম্পূর্ণ ডকুমেন্ট জমা দেওয়া। ইংরেজি অনুবাদ ছাড়া ডকুমেন্ট দেওয়া। ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান। অপ্রয়োজনীয় এজেন্টের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো IRCC-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ব্যবহার করা এবং সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ফাইল তৈরি করা। ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসার মধ্যে পার্থক্য অনেকে মনে করেন ওয়ার্ক পারমিটই ভিসা, কিন্তু আসলে দুটি আলাদা বিষয়: Work Permit: আপনাকে কানাডায় কাজ করার অনুমতি দেয়। Visa (Temporary Resident Visa): আপনাকে কানাডায় প্রবেশের অনুমতি দেয়।অর্থাৎ, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পরও দেশে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে ভিসা প্রয়োজন হতে পারে।ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ ও নবায়ন সাধারণত ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ ১ থেকে ২ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে আপনি চাইলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে Extension Application করে নবায়ন করতে পারেন। এর জন্য আপনাকে কানাডাতেই অনলাইনে আবেদন করতে হয় এবং নতুন LMIA বা জব অফার যুক্ত করতে হয়।


 ওয়ার্ক পারমিট থেকে স্থায়ী বসবাস (PR) পাওয়ার সুযোগ

একটি সুখবর হলো  আপনি কানাডায় কিছু সময় কাজ করার পর Permanent Residency (PR) এর জন্যও আবেদন করতে পারেন।এই সুযোগ সাধারণত Express Entry, Provincial Nominee Program (PNP) বা Canadian Experience Class (CEC) এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ওয়ার্ক পারমিট শুধু কাজের অনুমতি নয় এটি ভবিষ্যতে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসেরও এক সুন্দর সুযোগ তৈরি করে।


 কিছু কার্যকর টিপস

অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোথাও অর্থ প্রদান করবেন না। আবেদন জমা দেওয়ার আগে সব ডকুমেন্ট আপডেট আছে কিনা যাচাই করুন। ইমেইল চেক করুন নিয়মিত  অনেক সময় IRCC অতিরিক্ত তথ্য চায়। প্রয়োজনে অনুমোদিত Immigration Consultant (RCIC) এর সাহায্য নিতে পারেন।সব কাগজে আপনার নাম ও জন্মতারিখ একই থাকতে হবে।


 উপসংহার

কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা প্রক্রিয়া প্রথমে কিছুটা জটিল মনে হলেও, সঠিক প্রস্তুতি ও নিয়ম মেনে আবেদন করলে এটি সম্পূর্ণ সম্ভব। যদি আপনার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং সঠিক ডকুমেন্ট থাকে  তবে কানাডায় কাজ করার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে। কানাডা সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার বিদেশি কর্মীকে আমন্ত্রণ জানায়, তাই আজ থেকেই শুরু করুন আপনার প্রস্তুতি।সততা, ধৈর্য, এবং পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে গেলে “কানাডা ওয়ার্ক পারমিট ভিসা” আপনার হাতের নাগালেই! 





এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

Md. Abir Hossain
Md. Abir Hossain
একজন ডিজিটাল মার্কেটিং এক্সপার্ট ও অর্ডিনারি আইটির সিনিয়র সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার। তিনি অনলাইন ইনকাম, ব্লগিং, SEO ও টেকনোলজি নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। ৫ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি শিক্ষার্থীদের অনলাইনে সফল হতে সহায়তা করে যাচ্ছেন।